ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

রহস্যময় চায়নিজ নিউমোনিয়া কতটা ভয়াবহ

নিউজ ডেক্স

 প্রকাশিত: জানুয়ারী ০৪, ২০২৪, ০৪:১০ দুপুর  

ছবি সংগৃহিত

সারা পৃথিবীতে তাণ্ডব চালিয়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ নিয়েছে মহামারি ভাইরাস ‘কোভিড-১৯’। ২০১৯-২০ সালে চীন থেকে ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস। যার রাজত্ব এখনো চলছে বিভিন্ন দেশে। তারই মধ্যে নতুন আতঙ্ক ‘রহস্যজনক নিউমোনিয়া’। এরও উৎপত্তি সেই চীনেই। বিশ্বের জনবহুল দেশ চীনের রাজধানী বেইজিংসহ বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়েছে ‘রহস্যজনক নিউমোনিয়া’। যার শিকার হচ্ছে হাজারে হাজারে শিশু। আক্রান্ত শিশুদের প্রথমে ইনফ্লুয়েঞ্জার বিভিন্ন উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, এরপর শুরু হচ্ছে শ্বাসকষ্ট, যা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীর লক্ষণ।

চীনের পর ইউরোপের কয়েকটি দেশেও শিশুদের মারাত্মক নিউমোনিয়ার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমেরিকা, নেদারল্যান্ডস, ভারতে চায়নিজ নিউমোনিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। সদ্যোজাত থেকে ১৫ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে চীনের রহস্যময় নিউমোনিয়ার প্রকোপ বেশি দেখা দিয়েছে।

চীনে অজানা নিউমোনিয়াকে প্রথম দিকে বিশেষ ধরনের নিউমোনিয়া বা অজানা নিউমোনিয়া বলা হচ্ছিল। তার পরে এটিকে হোয়াইট লাং সিনড্রোমও বলা হয়। পরে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন এর পিছনে থাকা ব্যাকটিরিয়াটির ভূমিকার কথা। এখনও পর্যন্ত যা জানা গিয়েছে, চায়নিজ ওয়াকিং নিউমোনিয়া কোনও একটি ভাইরাস নয়, একাধিক ভাইরাসের প্রভাবে সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। যেমন, সার্স-কোভিড টু, প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা, এইচনাইনএনটু, রেসপিরেটরি সিনিক্যাল ভাইরা, মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া ভাইরাসের সম্মিলিত সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে রোগীর শরীরে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই শরীরে পড়ছে সাংঘাতিক প্রভাব।

অজানা এই রোগে আক্রান্ত হওয়া শিশুদের জ্বর হচ্ছে, ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তবে কাশি হচ্ছে না আক্রান্ত শিশুদের। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সেভাবে ছড়াচ্ছে না এই রোগ।

চিকিৎসকদের মতে, এটি একটি সংক্রামক বা সংক্রামক রোগ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, শ্বাসযন্ত্র-সংক্রান্ত রোগগুলি সংক্রামক। কাশি, হাঁচি ও কথা বলার মাধ্যমে এই রোগের ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে।

চিকিৎসকদের মতে, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া সবই মাইক্রোস্কোপিক প্যাথোজেন বা প্যাথোজেন যা থেকে এই জাতীয় রোগ ছড়ায়। চিকিৎসকরা ব্যাখ্যা করেছেন যে মাইকোপ্লাজমা একটি ব্যাকটিরিয়াল জীবাণু এবং এটি বেশিরভাগ শিশুদের আক্রমণ করে।

চিকিৎসকরা বলছেন, এটি গলা এবং শ্বাসযন্ত্রকে প্রভাবিত করে, যা থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে। রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস বা আরএসভি এক ধরণের ভাইরাস। এই ভাইরাসটি ‘আপার রেসপিরাটরি’, নাক এবং গলাকে প্রভাবিত করে। এটি সর্দি, কাশি এবং জ্বরেরও কারণ। মাইকোপ্লাজমা এএসভি বা ইনফ্লুয়েঞ্জা খুব সাধারণ রোগ, যা খুব গুরুতর না হলে অ্যান্টিবায়োটিক খেলে সেরেও যায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই উত্তর চিনে ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আর এই পরিসংখ্যানটাকে গত তিন বছরের একই সময়ের সঙ্গে তুলনা করা হলে দেখা যাবে, এবার রোগীর সংখ্যা অনেকটাই বেশি। সাধারণ নিউমোনিয়ার মতোই এতে ফুসফুসে সংক্রমণ ও জ্বরের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে রোগীর শরীরে। বমি ও ডায়ারিয়ার সমস্যাও দেখা যাচ্ছে একইসঙ্গে। একাধিক ভাইরাসের আক্রমণ দুর্বল করে দিচ্ছে শরীরকে।

চিকিৎসকের মতে, নিউমোনিয়ায় মূলত ক্ষতিগ্রস্থ হয় ফুসফুস। শ্বাসনালীতেও ছড়ায় সংক্রমণ। সাধারণ ক্ষেত্রে সময়ে চিকিৎসা হলে দিন সাতেকের মধ্যেই সেরে ওঠে রোগী। কিন্তু এক্ষেত্রে সংক্রমণের একটু বাড়াবাড়ি রূপ দেখা যাচ্ছে বলে খবর। শুরুতেই ধরা পড়লে সংক্রমণ বাড়াবাড়ি রূপ নেওয়ার আগে চিকিৎসা শুরু হলে তেমন আশঙ্কার কিছু নেই। তবে সংক্রমণ বাড়াবাড়ি রূপ ধারণ করলে সেক্ষেত্রে প্রাণ সংশয় হতে পারে। বিশেষত পাঁচ বছরের নীচের শিশুরা এই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন।

নিউমোনিয়ায় সর্দি কাশির সমস্যায় বাড়াবাড়ি হলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন। তবে বুকে ব্যথা, মারাত্মক শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব, সাংঘাতিক দুর্বলতা, ডায়ারিয়ার সমস্যা না কমলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন চিকিৎসক সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন।

​তবে শীতের শুরুর সময় নিউমোনিয়া, সর্দি-জ্বরের সমস্যা ঘরে ঘরে। তাই বাড়তি সতর্ক থাকলেই সমস্যা এড়ানো সম্ভব। বিশেষত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সতর্কতা খুব দরকারি।

চিকিৎসকের মতে, বয়স ছয় মাসের কম এমন শিশু যদি বুকের দুধ পান করে, তবে সে নিউমোনিয়ার জীবাণু অনেকটাই প্রতিহত করতে পারবে। যে শিশুর বয়স ছয় মাসের বেশি, তাদের যদি বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার হিসেবে দেশীয় খাবার খাওয়াতে পারেন, তবে খুব ভালো।

এ সময় শিশুর গোসলে কুসুম গরম পানি ব্যবহার করুন। শীতে শিশুদের ডায়াপার ঘন ঘন পরিবর্তন করা উচিত। এই রোগের চিকিৎসা সাধারণত নির্ভর করে কী ধরনের নিউমোনিয়া রোগীকে আক্রমণ করছে তার ওপর। তাই ওপরের লক্ষণগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

নিউমোনিয়া প্রতিরোধে প্রচুর পানি পান করতে হবে। এতে করে শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন উপাদান বের হয়ে যায়। ফলে শরীর থাকে সুস্থ। শীতে ডিহাইড্রেশন এড়াতে জলের পাশাপাশি পান করুন টাটকা ফলের রস। এ সময় যত বেশি তরল পদার্থ শরীরে যাবে, ততই ক্ষতিকারক কণা শরীর থেকে বের হয়ে যাবে। ফলে শ্বাসযন্ত্রও থাকবে সুস্থ।

নিউমোনিয়া একটি প্রদাহজনিত সমস্যা। এই রোগ প্রতিরোধে পাতে রাখুন প্রদাহবিরোধী খাবার। অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেলে নিউমোনিয়া থেকে দ্রুত আরোগ্য মেলে। এজন্য পাতে রাখুন বিভিন্ন ধরনের বাদাম যেমন- কাজুবাদাম, কাঠবাদাম, আখরোট ইত্যাদি। এছাড়া প্রতিদিনের ডায়েটে বিভিন্ন বীজ ও মুরগির মাংসের মতো প্রোটিন রাখুন।

সুস্বাস্থ্যের জন্য শীতে মৌসুমি সব শাকসবজি খেতে হবে। পালং শাক, লাল শাক, কলমি শাক’সহ মৌসুমি সব সবজি পাতে রাখুন। এসবের পুষ্টিগুণ শরীরকে বিভিন্ন রোগের সঙ্গে লড়াই করতে শক্তি জোগায় এমনকি ফুসফুসসের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে।

ভিটামিন সি গ্রহণ করুন। শীতের বাজারে মৌসুমি বিভিন্ন ধরনের ফল মেলে, যেগুলোতে ভিটামিন সি ভরপুর থাক। ভিটামিন সি’যুক্ত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। এসবের অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রভাব শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।এছাড়া আদা খাওয়ার মাধ্যমেও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি প্রভাব মিলবে শরীরে। শরীর হোক বা ত্বক এই উপাদান খুবই জরুরি।

নিউমোনিয়া থেকে সুরক্ষিত থাকার সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর উপায় হলো বারবার হাত ধোওয়া। আর হাত ধুতে না পারলে স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাত পরিষ্কার করুন। হাত না ধুয়ে মুখ, চোখ ও নাকে হাত দেবেন না। খেতে বসার আগেও ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। ঝুঁকি এড়াতে নিউমোনিয়ার টিকা নিন। বয়স ও শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে নিউমোনিয়ার টিকা দেওয়া হয়। নিউমোনিয়া থেকে সুরক্ষিত থাকতে শিশুদেরও টিকা দিয়ে রাখা জরুরি। টিকা দেওয়া থাকলে নিউমোনিয়া এমনকি শীতকালীন নানা সংক্রমণের ঝুঁকিও কমে।

২৪ ঘন্টা আপডেট নিউজ পেতে bdtribune24/বিডিট্রিবিউন২৪ এর ফেসবুক পেজ ফলো করুন