ঢাকা, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২

উত্তর জনপদের চরাঞ্চলে বালুর বুক চিড়ে ভূট্রা চাষে অর্থনৈতিক বিপ্লব 

কাঠফাটা রোদের মধ্যে যেন তাদের কাজের কোন স্থবিরতা নেই।

এম সাদ্দাম হোসেন পবন

 প্রকাশিত: এপ্রিল ২৯, ২০২৫, ০৭:০৮ বিকাল  

গাইবান্ধা জেলার তিস্তা,ব্রম্মপৃত্র ও যমুনা নদ-নদী বেষ্টিত চার'টি উপজেলার দূর্গম চরাঞ্চলের বালুতে ভূট্রা চাষ করে চরের জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক বিপ্লব তৈরী করেছেন। 

চরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, ভূট্রার কলা ছিড়তে কাজে দিনমজুররা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কাঠফাটা রোদের মধ্যে যেন তাদের কাজের কোন স্থবিরতা নেই। কাল বৈশাখী ঝড়ের আশংকায় চরাঞ্চলের হাজার হাজার হেক্টর বালু ভূমিতে ভূট্রার কলা ছিড়ে তা মাড়াই করতে নারী শ্রমিকদের ব্যাপক কর্ম-যজ্ঞের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
 
 গাইবান্ধা সদর,সুন্দরগঞ্জ,ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলের দৃশ্যপট অর্থনৈতিক সবুজ বিপ্লবে পাল্টে দিয়েছে  অর্থকরি ভূট্রার চাষাবাদের সম্ভাবনার দুয়ার। 
ভূট্রার বাজার দর জানতে কামারজানী বন্দরের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. সোলাইমান ইসলাম মাষ্টার বলেন, চলতি এই মৌসুমে মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে এপ্রিলের পহেলা সপ্তাহেও তেরশ থেকে সাড়ে বারো'শ টাকা ভূট্রার মন ছিল কিন্তু বাজারে এখন প্রতিমন ভূট্রা এগারো'শ এর নিচে হাজারে নেমে এসেছে। তবে আমদানি বেশি হওয়ায় ফিড কোম্পানিগুলো দাম কমিয়ে দিয়েছে।
 
স্থানীয় কৃষকদের নিকট থেকে উৎপাদন খরচের বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হলে তারা জানান, প্রতি একর জমিতে ভূট্রা চাষাবাদ খরচ আশি হাজর থেকে নব্বই হাজার কিন্তু ভূট্রা আসে একশ দশ মন থেকে একশ পনেরো মন ভূট্রা আসে। 
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ- পরিচালকের দপ্তর সূত্র বলছে, চলতি এই মৌসুমে গাইবান্ধা জেলায় এক লাখ চল্লিশ হাজার সাত শ পঞ্চাশ জন কৃষকের হাতে সতের হাজার পাঁচ উননব্বই হেক্টর ভূমিতে ভূট্রা চাষ হয়েছে যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ চৌরনব্বই হাজার তিনশ সত্তুর মেট্রিক টন।
 কিন্তু সরকারি কৃষি দপ্তরের পরিসংখ্যানের দ্বিগুণ ভূমিতে ভূট্রা চাষ হয়েছে বলেও অনেক কৃষক দাবি করেছেন। 
 
উত্তর জনপদ বড় বাণিজ্যিক বন্দর কামারজানী বন্দরে চরাঞ্চল থেকে আসা দৈনন্দিন শত শত  ভূট্রা বোঝাই নৌকা নৌ-ঘাটে ভীড়ছে এবং সরাসরি তা ট্রাক বোঝাই হয়ে দেশের বিভিন্ন ফিড কোম্পানিসহ খাদ্য দ্রব্যের কারখানায় যাচ্ছে।  দৈনিক তিন-চার শ ট্রাকে করে ভূট্রা বিক্রি হওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ভাল মুনাফা অর্জন করতে পারছেন। মৌসুমের চার মাস ধরে চরাঞ্চলের ভূট্রার ব্যবসায় ব্যস্ততম বন্দর নগরী হিসাবে চব্বিশ ঘণ্টা ভূট্রার ট্রাক লোড চলে। 
এদিকে ভূট্রার লাভে হাজার হাজার পরিবার দু-চারটা করে গাভী প্রতি মৌসুমে কিনতে পারছে। ফলে গাভী ও ভূট্রার দুটো দু'দিকেই আয়ের একটি বড় ক্ষেত্র তৈরী হওয়ায় চরাঞ্চলে অর্থবিত্তে গরীব-ধনীর বৈষম্য কমতে শুরু করেছে। 
 
কামারজানী বন্দরের ভূট্রা ব্যবসায়ী মো. ইকবাল হোসেন বলেন, গমের আবাদের বিকল্প হিসাবে ভূট্রার চাষে অভাবনীয় সাফল্য চরাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এসেছে। ভূট্রার চাষে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে হাজার হাজার নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবার। তাদের ঘরে পাঁচ থেকে অধিক গাভী আছে যা ভূট্রা চাষের লাভের অংশে কেনা। 
 
সুন্দরগঞ্জের কাপাসিয়া ইউনিয়নের ভাটি বোচাগাড়ী চরের মোছা: আলেমা বেগম বলেন, ঘরের গেরস্ত ক্ষেতে গিয়ে কামলা সাথে কাম করতেছে। পোলা-মাইয়াদের নিয়া আমি ভূট্রা মাড়াই করছি। ঝড়-তুফানে পাতারোত ক্ষেতের ভূট্রা পড়ে আছে। কামলা সময় মতো পাওয়া যায় না। 
 
গাইবান্ধা সদরের কামারজানী ইউনিয়নের খামার কামারজানী চরের বিদেশ ফেরত মো. বেল্লাল হোসেন বলেন, আমি বিদেশ যাওয়ার জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে প্রায় বিশ লক্ষ টাকা প্রতারনায় ক্ষতিগ্রস্ত হই। বিদেশে গিয়ে কাজ করতে পারি নাই,দেড় মাসের ব্যবধানে ফিরে এসে উচ্চ মুনাফায় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পঁচিশ একরের মতো ভূট্রার ক্ষেত লাগাই। ক্ষেতের ভূট্রা মাড়াই করে সকলের দেনা পরিশোধ করেছি এবং বিদেশ যেতে যত ধার দেনন ছিল তা কিছু কমিয়ে এনেছি। ভূট্রা চাষে শ্রম দিতে পারলে লাভ হবে। 
 
গাইবান্ধা সদরের মোল্লারচর ইউনিয়নের বাজে চিথুলিয়া গ্রামের আফছার আলী দেওয়ানি বলেন, পোলারা সবটি মিলে এবার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ একরের মতো ভূট্রা লাগিয়েছে। অর্ধেক ক্ষেতে এখনো ভূট্রা ছিড়ে নেয়া হয়নি। তবে ঝড় ঝাপটায় ক্ষতির চিন্তা হচ্ছে। দেরিতে কিছু ভূট্রা লাগানোয় তা আসতে সময় লাগবে। তবে আমাদের চরাঞ্চলের মানুষদের স্বচ্ছলতা ভূট্রা চাষে হয়েছে। 
 
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খোরশেদ আলম বলেন, দূর্গম চরাঞ্চলের পতিত জমিগুলো আবাদের আওতায় আসায় দেশে খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় এই ভূট্রাচাষ অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সরাসরি দুই লক্ষাধিক কৃষক অর্থকরি ফসল ভূট্রা চাষে অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছলতায় এসেছে। আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা চরাঞ্চলের কৃষকদের চাষাবাদ সমস্যা সমাধানে নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছে।