বৈষম্যহীন বাংলাদেশে তিনি তার পদ ফিরে পাবেন তো!
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে পাটোয়া মেহেদীবাগ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক আজও নিজ পদের স্বীকৃতি পায়নি
প্রকাশিত: জুলাই ০৮, ২০২৫, ০৭:২৫ বিকাল

বিশেষ প্রতিনিধি:
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নাকাই ইউনিয়নে অবস্থিত মেহেদীবাগ উচ্চ বিদ্যালয়টি যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিজের অর্থ ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আজও সেই প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম নিজ পদে স্বীকৃতি পায়নি। এই প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ১৯৯৮ সালের পূর্বে গ্রামীন ব্যাংকে চাকুরীরত ছিলেন। মামা কে,এম,এ খালেক প্রায়ই যোগাযোগ করে ভাগ্নে মো: সফিকুল ইসলামকে গ্রামীন ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে নতুন এই মেহেদীবাগ উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপনে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার অনুরোধ করলে ১৯৯৯ সালের প্রথম দিকে মো: সফিকুল ইসলাম ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে এই বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। শুন্য থেকে প্রতিষ্ঠানটি নিরলসভাবে পরিচালনার মাধ্যমে পরীক্ষার ফলাফলসহ এলাকায় গ্রহন যোগ্যতা বেড়ে যায়। ১৯৯৮ সালের প্রতিষ্ঠার সূচনা থেকে একাধারে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব ২০০৮ সালের শেষ দিকেও পালন করেছেন।
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম শারিরীক ভাবে অসুস্থ হওয়ায় তাকে চিকিৎসার জন্য রংপুর,ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। তার এই অসুস্থতার সুযোগে ২০০৯ সালের দিকে নতুন সরকার আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহনের পর ওই এলাকার দলীয় প্রভাব এবং কমিটির অপ-কৌশল করে কাম্য যোগ্যতাহীন জুনিয়র শিক্ষক মো: আব্দুর রশিদ সেখকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বেআইনি ভাবে প্রতিষ্ঠাতা মো: সফিকুল ইসলামের স্থলে নিয়োগ দেয়া হয়। অথচ প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম কে কোন নোটিশ বা অবগত না করে গোপনে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কে,এম,এ আব্দুল খালেক অবৈধ ভাবে রেজুলেশনে এই বেআইনি নিয়োগ প্রদান করেছেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে নানাবিধ মানসিক চাপ সৃষ্টি করে ছিল স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীসহ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কে,এম,এ আব্দুল খালেক। নিয়োগ বাণিজ্য করার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য অবৈধ পন্থায় অযোগ্য জুনিয়র শিক্ষককে প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়োগ দেন সভাপতি কে,এম,এ খালেক। সেই সাথে তার পরিবারের সদস্যসহ আত্মীয় স্বজনদের অনেকে এই প্রতিষ্ঠানে অবৈধ ভাবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে নিয়োগ কালিন সময়ে কাম্য যোগ্যতা না থাকলেও ভূয়া কাগজে তারা বহাল তবিয়তে আছেন।
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম বেআইনি বা অবৈধ কোন কাজে সম্মত না হওয়ায় সভাপতি কে,এম,এ আব্দুল খালেক ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে নিয়মনীতি না মেনে সেই প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের দ্বারা নিয়োগ পাওয়া জুনিয়র শিক্ষক আব্দুর রশিদকে ওই পদে নিয়োগ দেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় ওই পদে একই প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র শিক্ষককে কাম্য যোগ্যতা ছাড়াই অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে নিয়োগ করায় এলাকায় ব্যাপক সমালোচনা সেসময় মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়। কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মী হওয়ায় এই বেআইনি ও অমানবিক নিষ্ঠুরতম ঘটনায় ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কোন প্রতিকার বা বিচার পায়নি। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী শাসনের পুরো সময় অনেক অভিযোগ দিয়েও কোন আশানুরূপ বিচার না পাওয়ায় এক ধরনের হতাশায় ভুগছেন সেই নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করা প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরো ব্যানবেইস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জরীপ-২০২৪ সূত্র বলছে, বিদ্যালয়টি ১৯৯৮ সালে নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে স্থাপিত হয়। প্রতিষ্ঠানের অনুমোদিত পদের সংখ্যা টিচিং ১৬ জন ও নন-টিচিং স্টাফ ০৬ জন মোট শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ২২ জন হলেও কর্মরত টিচিং স্টাফ ১৩ জন এবং কর্মচারী ৩ জন। মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৩ অক্টোবর ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভূক্ত হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানে নিম্ন-মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৫৫ জন ছাত্র-ছাত্রী এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২১৭ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছেন।
প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠার পরের বছর ২০০০ সালে পাঠদানের অনুমতি প্রাপ্ত হয় এবং ২০০৩ সালে প্রথম একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করে। প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম স্বেচ্ছায় ইস্তেফা পত্র বা পদ থেকে সরে আসেননি।
এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক গন্যমান্য ব্যক্তি জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষকের সাথে চরম অন্যায় হয়েছে। এই সময়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে তার সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা দেয়া হোক।
স্থানীয় আরিফ হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, তৎকালীন প্রধান শিক্ষক সফিকুল ইসলাম স্যারের অনেক ত্যাগে এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্যার না খেয়ে স্কুলের কাজে টাকা যোগান দিতো। অথচ স্যারকে কিছু না জানিয়ে তার পদে এই স্কুলের জুনিয়রকে মনগড়া নিয়োগ দেয়ায় তখন এলাকায় ব্যাপক সমালোচনা ছিল। তবে স্যারের সাথে যে অন্যায় করেছে তা অমানবিকসহ মোটেও কেউ কারো সাথে করে না। যে মানুষটি সন্তানের মতো স্কুলটি গড়ে তুলেছে তার শারিরীক অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে এরা স্যারের সাথে প্রতারনা করেছে।
ওই সময়ের ছাত্র আব্দুল লফিত বলেন, এতো সহজ সরল সাদাসিধা নৈতিকতার মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। স্যারের সাথে যা করেছে তা সত্যি অমানবিক জুলুম বলতে পারেন। স্যার চেয়ে ছিল ঘুষ,দূর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক কিন্তু সভাপতি চাইতেন নিয়োগের টাকা যা স্যারের পক্ষে করা সম্ভব ছিলনা জন্য তাকে বাদ দেয়।
ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম এর স্ত্রী ছন্দা আক্তার বলেন, আমার স্বামী যখন ব্যাংকে ছিল তখন আমরা অনেক সুখে-শান্তিতে ছিলাম। আমার মামাশ্বশুর বারংবার অনুরোধ করায় আমার স্বামী চাকুরী ছেড়ে এসে নতুন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়। ১৯৯৮ সাল থেকে তার শারীরিক অসুস্থতায় ২০০৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্বরত ছিলেন বিনা বেতন ভাতায় কিন্তু অসুস্থতার সুযোগে তাকে বাদ দিয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে প্রতিকার চেয়ে অনেক অভিযোগ করেও আওয়ামী শাসনের সময়ে ন্যায় বিচার চাইনি। এখনো অনিশ্চয়তা দেখছি,বৈষম্যই থেকে যাবে হয়তো।
জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম বলেন, নিজের সন্তানের চেয়েও অনেক দরদী দীর্ঘশ্বাস এই প্রতিষ্ঠানে রয়েছে। জীবনে এধরনের অত্যাচার হবে তা ভাবতে পারিনি। আমার আক্ষেপ হচ্ছে, আমাকে না জানিয়ে আমার পদে আরেকজন বসে ছিল। এটা চরমভাবে অবমাননাকর ছিল। আওয়ামী শাসনের সময়ে অনেক অভিযোগ করেছি তবে তা মোটেও প্রশাসন আমলে নিতে আগ্রহ দেখায়নি। বৈষম্যহীন বাংলাদেশে ন্যায় বিচারের জন্য হয়তো আরেকবার বিচারিক আদালতে আর্জি পেশ করবো। যদি হতাশায় নিমজ্জিত হই তবে বুঝতে পারবো এই পৃথিবীতে ন্যায় বিচার বলতে ক্ষমতাধরেরা।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলা হলে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক পদে থাকা আব্দুর রশিদ সেখ বলেন, প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক মো: সফিকুল ইসলাম পদে থাকাকালীন আমাকে জুনিয়র শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ করা হয়। আমি সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলাম না। তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটি আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। ওই সময় থেকে আমি প্রধান শিক্ষক পদের দায়িত্ব পালন করছি। ভূয়া কাগজের ছড়াছড়ি সম্পর্কে তিনি জানান, এটা আমার জানা নেই। তৎকালীন সভাপতি অনেককে নিয়োগ দিয়ে ছিল।
বিষয়টি নিয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার এ,কে,এম মামুনুর রশিদ বলেন, আমি নতুন এসেছি। এই বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করবো। তবে ভুক্তভোগী প্রতিকারের জন্য যথাযথ কতৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দিলে কতৃপক্ষ অবশ্যই বিষয়টি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহন করবে। আমার দপ্তরে কোন সেবা বা ন্যায় সঙ্গত সহায়তা করবো।