মেয়েসহ স্বামী-স্ত্রীকে হত্যা, পরিকল্পিত বলছে পুলিশ
প্রকাশিত: জানুয়ারী ৩১, ২০২৪, ০১:০০ রাত
ছবি সংগৃহীত
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে একমাত্র মেয়েসহ স্বামী-স্ত্রীকে হত্যার ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে এলাকাবাসী। ভদ্র ও সাধারণ জীবনযাপন করা ধনী এই পরিবারের তিনজনকে একসঙ্গে হত্যার ঘটনায় নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলছে পুলিশ। পাশাপাশি হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকটি ক্লু নিয়ে কাজ করছে।
সোমবার (২৯ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ৩টার দিকে তাড়াশ পৌর শহরের বারোয়ারী বটতলা এলাকার কালিচরণ সরকারের ছেলে বিকাশ সরকার (৪৫), তার স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার (৪০) ও মেয়ে তাড়াশ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী পারমিতা সরকার তুষির (১৫) গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বজনরা দুদিন যাবত তাদের খোঁজ না পেয়ে পুলিশকে খবর দিলে ঘরের তালা ভেঙে মেঝেতে ও বিছানায় তাদের গলাকাটা মরদেহ পাওয়া যায়।
নিহত বিকাশ সরকার হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তাড়াশ উপজেলা শাখার কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। বিকাশরা সাত ভাইবোন। তারা পাঁচ বোন ও দুই ভাই। বিকাশ সবার ছোট ছিলেন।
এদিকে মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) দুপুরে নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্ত শেষে আগামীকাল দুপুরের দিকে মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হতে পারে। এ ঘটনায় নিহত বিকাশের সম্বন্ধী (স্ত্রীর ভাই) বাদী হয়ে তাড়াশ থানায় হত্যা মামলা করেছেন।
উল্লাপাড়া সার্কেলের (উল্লাপাড়া-তাড়াশ) সহকারী পুলিশ সুপার, শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও পূজা উদযাপন পরিষদের নেতাকর্মী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় একাধিক ব্যাক্তির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তপন কুমার গোস্বামী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতকাল (সোমবার) রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে আমাকে মোবাইলে কল করেন বিকাশের ভগ্নিপতি চন্ডী দাস। ফোন দিয়ে বলেন, দুদিন হলো ওদের ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না, আবার তাদের সম্পর্কে কেউ কিছু বলতেও পারছে না। আমার ছেলেরা প্রাইভেটকার নিয়ে তাড়াশে গিয়েছে। তুমি একটু তাদের সঙ্গে গিয়ে দেখতো কী হয়েছে। পরে আমি তাড়াশ উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আনন্দ ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে ওই বাড়িতে যাই।
তিনি হলেন, তখন প্রায় রাত দেড়টা বাজে। বাড়ির তিন তলায় গিয়ে দেখি তারা যে ফ্ল্যাটে থাকেন সেই ফ্ল্যাটের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগানো। পরে তার মোবাইলে কল দিলে ভেতরে তার মোবাইলে রিং বাজতে শুনি। তখন আমরা সেখান থেকে থানায় গিয়ে বিষয়টি জানাই। পরে পুলিশ এসে দরজার তালা ভাঙতেই দেখি ভেতরে তিনজনের মরদেহ পড়ে আছে।
তপন গোস্বামী বলেন, দরজা খোলার পর প্রথম ঘরেই দেখি বিকাশের গলাকাটা মরদেহ পড়ে আছে। পাশের ঘরে গিয়ে দেখি সেখানে নিচে বিকাশের স্ত্রীর ও বিছানায় তার মেয়ের মরদেহ পড়ে আছে। তাদের দুজনেরও গলাকাটা ছিল।
তিনি বলেন, শনিবার বিকেলে আমরা সবাই উপজেলার দেশিগ্রামে শিবমন্দিরের কমিটি গঠন নিয়ে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ বিকাশ বলল, তার কাছে কিছু লোকজন আসছে, তাকে দ্রুত বাড়িতে যেতে হবে। বলেই ৫টার দিকে সে চলে আসে। এরপর থেকে তাকে আর দেখাও যায়নি, মোবাইলেও পাওয়া যাচ্ছিল না।
পূজা উদযাপন পরিষদের এই নেতা বলেন, বিকাশের সঙ্গে তার ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি প্রকাশ সরকারের জমিজমা নিয়ে বিরোধ ছিল। এটা নিয়ে তাদের মাঝে বেশ কয়েকবার সালিশ বৈঠকও হয়েছে। এ ছাড়াও তার কোনো ছেলে সন্তান না থাকায় কিছুদিন আগে বিকাশ ১৭-১৮ বিঘা জমি তার স্ত্রীর নামে লিখে দিয়েছেন। এটা নিয়েও ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা ছিল। এক সময় সে ওষুধের ব্যবসা করলেও ৫-৬ বছর আগে ভাইয়ের কারণেই তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। এখন সে জমিজমা দেখাশোনা ও পুকুরে মাছ চাষাবাদ করতো।
তিনি বলেন, বিকাশ ধনী ব্যক্তি হলেও সে সাধারণ জীবনযাপন করত ও ভালো মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিল। তার ইউনিটের ৩-৪ হাত পাশেই তার ভাই প্রকাশের ফ্ল্যাটের দরজা। তিনটা হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল কিন্তু তারা বুঝলেন-ই না, এটা নিয়ে খুব আলোচনা চলছে। এছাড়াও এ ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা তাড়াশ বাজার।
এ ব্যাপারে উল্লাপাড়া সার্কেলের (উল্লাপাড়া-তাড়াশ) সহকারী পুলিশ সুপার অমৃত কুমার সূত্রধর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোর থেকে এখন অবধি আমি এখানেই আছি। একটা হত্যাকাণ্ডের পরে পুলিশের অনেক বিভাগের অনেক কাজ থাকে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ফুট প্রিন্ট, রক্তের স্যাম্পল, ডিএনএ নমুনা ছাড়াও নানান রকমের নমুনা সংগ্রহ করেছে। এরপর মরদেহগুলো উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। আমরা ধারণা করছি শনিবার রাতেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। বিকাশের শরীরে যে পোশাক ছিল তাতে মনে হচ্ছে সে বাইরে থেকে বাসায় এসেছিল। এ ঘটনায় নিহত বিকাশের সম্বন্ধী (স্ত্রীর ভাই) সুকমল সরকার বাদী হয়ে থানায় হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার না হলেও আমরা নানা বিষয়ে পর্যালোচনা করে কিছু ক্লু নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি খুব দ্রুত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে পারব।
সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মুনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ বিকেলে নিহত তিনজনের মরদেহ মর্গে এসে পৌঁছেছে। আগামীকাল সকালে তাদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে দুপুরের দিকে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে এর আগে তাড়াশে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি উল্লেখ করে তাড়াশ পৌরসভার মেয়র মো. আব্দুর রাজ্জাক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এমন ঘটনা তাড়াশকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়েছে। তাড়াশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এর আগে ঘটেনি। বিকাশ খুবই ভালো ছেলে ছিল।
তিনি বলেন, আল্লাহ তাকে অনেক ধন সম্পদ দিয়েছে। কিন্তু এগুলো ভোগ করার কেউ রইল না, পুরো পরিবারকে মেরে ফেলা হলো। তবে কেন এমন হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বুঝতে পারছি না। নিশ্চয়ই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী মূল ঘটনা উদঘাটন করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনবে।
এদিকে জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, নিহত বিকাশের সম্পর্কে জানতে ও সার্বিক তথ্যের জন্য বিকাশের ভাই প্রকাশ সরকার ও তার ছেলেকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডাকা হয়েছিল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।